মানুষ জন্মগতভাবে কোনো এক শ্রেণি বা বৈশিষ্ট্যে জন্মগ্রহণ করে। সামাজিকভাবে তাদেরকে একটি স্বীকৃত ভূমিকা বা সংজ্ঞা প্রদান করা হয়। যেমন জন্মগত শারীরিক বৈশিষ্টকে কেন্দ্র করে ব্যক্তিকে পুরুষ বা মহিলা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা। এরকম বৈশিষ্টকে কেন্দ্র করে ব্যক্তিকে সংজ্ঞায়িত করা অযৌক্তিক বা দুষ্ট কোনো পদ্ধতি, কর্মযজ্ঞ বা পদক্ষেপ নয়। বরং ব্যক্তিকে তার যোগ্যতা বা গুণাবলি অনুযায়ী ভূমিকা প্রদান করাই হলো সমতা। ব্যক্তিকে কোনো একটি সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করে তার যোগ্যতাকে দমিয়ে রাখলে সেটা সামাজিক বৈষম্য বা অসমতা হিসেবে চিহ্নিত হয়।
সামগ্রিকভাবে সকলকে কোনো এক প্লাটফর্মে মূল্যায়ণ করতে হলে এমন কোনো বিষয়কে প্যারামিটার ধরা যুক্তিযুক্ত নয় যেটাতে মানুষের কোনো হাত নেই বা দোষ নেই; যেমন- শারীরিক বৈশিষ্ট্য। সংঘবদ্ধভাবে বসবাসের ক্ষেত্রে জন্মগত এসব গুণাবলীর উর্ধ্বে এসে আমরা নতুন করে কোনো একটা গুণাগুণ তৈরি করি যার ভিত্তিতে সকলকে মূল্যায়ণ করা যায়; যেমন- শিক্ষা। বসবাসের ক্ষেত্রে এবং মানুষকে যদি কোনোভাবে মূল্যায়ন করতে হয় তাহলে এটাই আমাদের প্যারামিটার হওয়া উচিত এবং সকল গোষ্ঠীর লোকদের মাঝে সমানভাবে এই সামাজিক মূল্যবোধ পৌছানোর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সকল পদক্ষেপ নিশ্চিত করা উচিত। কোনো নির্দিষ্ট এলাকার বা বর্ণগোষ্ঠীর সদস্য যদি এই সামাজিক প্যারামিটার অর্জনে বাধাগ্রস্থ হয় বা পিছিয়ে পরে তাহলে তাদেরকে মূলধারার সাথে যুক্ত করার পদক্ষেপই হলো সমতা নিশ্চিতকরণ প্রক্রিয়া। এই পদক্ষেপটাকে আমরা কোটা সিস্টেম বলতে পারি। এই সামাজিক প্যারামিটারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সকলকে একই ধারায় আনতে যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা রাষ্ট্রের জন্য উপযুক্ত, ন্যায়সংগত; দায়িত্ব।
কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই মূলকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রবণতা খুব কমই দেখা যায়। আমাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে আমরা এই মূলকে অনেক সময় শিথিল করি; সকলকে সমানভাবে পরিমাপ করার ক্ষেত্র তৈরি করি না। যেমন ধরুণ আদিবাসীদের মূলধারার উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে কী কী ধরণের অসুবিধা আছে সেটা নির্ণয় করে তাদেরকে মূলধারায় আনতে যেটা প্রয়োজন সেটা তাদের মত করে গোড়া থেকেই সাজিয়ে দেওয়া। অর্থাৎ প্রাইমারী স্কুল থেকে। তেমনিভাবে যত ধরণের গোষ্ঠী বাংলাদেশে বিদ্যমান তাদেরকে শিক্ষা মূল ধরে সেই ধারায় নিয়ে আসা যেনো সারা বাংলাদেশের সকল শিশু একযোগে সমানভাবে বেড়ে উঠার পরিবেশ পায়। আমাদের কাজ করার ক্ষেত্র এখানে হওয়া উচিত ছিলো।
শারীরিকভাবে অক্ষম বা স্পেশাল চাহিদা সম্পন্ন কিছু ব্যক্তি আমাদের সমাজে সবসময়ই থাকে। তাদের ক্ষেত্রে স্পেশাল কোনো বৈশিষ্টকে মূল ধরে, তাদের মত করে এবং তাদের মধ্যকার সামষ্টিক জনগোষ্ঠীকে মূল্যায়ণ করে তাদেরকে মূল ধারায় সংযুক্ত করা যেতে। সেক্ষেত্রে তাদের লেভেল অনুযায়ী পদ বা দায়িত্ব দেয়াই যুক্তিযুক্ত ছিল।
কিন্তু আমরা কী করলাম? এর বিপরীতে উচ্চতর শিক্ষায়, চাকুরীর ক্ষেত্রে তাদেরকে সকলের সাথে তাদের লেভেলে মাপা শুরু করলাম (পরীক্ষায় কোটা সিস্টেম)। এটাকে যৌক্তিককরণ করা হয় ‘সামজিকভাবে অবহেলিত ও অনগ্রসর’ বলে। এতে তাদের inclusion হলেও দিনশেষে দেশের বা দশের কোনো উপকার হয় না। তাদেরকে নামমাত্র সামাজিক inclusion করার প্রবণতা থাকার দরুণ ছোটবেলা থেকে তারা এক ভিন্ন মন মানসিকতায় বেড়ে ওঠে। কোনো ক্ষেত্রে হয়ত তাদেরকে বেড়ে উঠার সঠিক পরিবেশ তৈরি করে দেয়া হয় না বা শিথিলতা প্রদর্শন করা হয়, আবার কোনো ক্ষেত্রে তারা নিজেরা এই ধারণায় বেড়ে উঠে যে অল্পতে তারা পার হতে পারবে। এই পদ্ধতিতে মূল ধারার সাথে যুক্ত হওয়ার ফলে সাধারণ শ্রেনি তাদেরকে ভিন্ন শ্রেণি বলে ধরে নেয়। তাদের কারণে যারা যুক্ত হতে পারে নাই তাদের মনে এই জনগোষ্ঠীর প্রতি এক ধরনের বিদ্বেষ তৈরি হয়। দিনশেষে আবার তারা সামাজিকভাবে এক ভিন্ন শ্রেণিই থেকে যায়। মূলধারার সাথে কখনো তারা সংযুক্ত হতে পারে না। এমনিভাবে আবার তারা সামাজিক অসমতা বা বৈষম্যের শিকার হয়।
আবার দেশের কথাই ধরুন। যে কোনো চাকুরীর ক্ষেত্রে আমরা কোনো এক নির্দিষ্ট শ্রেণিকে মূলধারা থেকে পৃথক করে নিম্ন এক স্কেলে মূল্যায়ণ করি যেখানে যোগ্য ও দক্ষ একদল লোক বাদ পড়ে যায়। দেশের সেবায় এরা এদের মধ্যে অর্জিত অভিজ্ঞতা দিয়ে কাজ করে, যেখানে দেশ আরো ভালো যোগ্যতা সম্পন্ন লোকের সেবা পেতে পারত। আমার এক বন্ধু তার ডিপার্টমেন্টের স্যারকে কোনো এক গভীর বিষয়ে প্রশ্ন করলে তার জবাবে তিনি নির্দ্বিধায় হেসে বলে উঠলেন “আমাকে এত গভীর প্রশ্ন করো না। আমি (কোনো এক কোটাকে উল্লেখ করে) অমুক কোটায় শিক্ষক হয়েছি”। এভাবে আমরা তথাকথিত সমতা ও inclusive development এর নামে দেশের ক্ষতি করছি, নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে তাদের গন্ডিতে রাখছি, এবং প্রগতির নামে দেশকে অবনমন করছি।
বছরের পর বছর এভাবে বাংলাদেশের নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী আমাদের নাগালের বাইরেই থাকছে। কিছু সংখ্যায় তারা মূল ধারায় আসতে পারলেও তাদের ভিতরে হীনমন্যতা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মনে তাদেরকে দুর্বল ভাবার প্রবণতা থাকার কারণে তারা মূলধারার জনগোষ্ঠীর মাঝে মাথা উচু করে চলতে পারে না। যার ফলে তাদের মধ্যে লালিত ভিন্ন গুণ সম্বলিত কৃষ্টি কালচারও আমাদের লোকাচারে দৃষ্টিগোচর হওয়ার সুযোগ হয় না।