মৃত্যু ও মৃত্যু ভয় (২)
দুনিয়া আসলে চিরস্থায়ী কোনো আবাস নয় [১]। এটা একটা পাঠশালা, পরীক্ষাগার, পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র [২]। এখানে মানুষ স্বাধীন [৩]। ভালো-মন্দ দুটো পথ দেখানো আছে [৪]। দুটো পথের যে কোনো পথে চলার উপকরণ ও সামর্থ্য দুটোই দেয়া হয়েছে [৫]। কি বিষয়ে পরীক্ষা হবে সেটাও বলে দেয়া আছে। পরীক্ষায় ভালো করলে আমাদের আদি নিবাস জান্নাতে ফিরতে পারব, না হলে জাহান্নামে থাকতে হবে [৬]। মৃত্যু হলো এই পরীক্ষাগার থেকে বিচার কেন্দ্রে যাওয়ার মাধ্যম, যেখানে ফলাফল অনুযায়ী প্রতিদান প্রদান করা হবে [৭]।
এ দুনিয়া মানুষের কোনো জাতগত আবাসস্থল নয় [৮]। যদি তা-ই হতো তাহলে জন্মের পরই আমরা কারো সাহায্য ছাড়া অন্যান্য প্রাণীর মত চলতে পারতাম। সামনে দৃশ্যত যে কোনো খাবার খেতে পারতাম, হারাম বা অরুচি থাকত না। কোনো খাবার প্রস্তুত করার ঝামেলা থাকত না। হিংস্র প্রাণীর মত শিকারের আগাগোড়া সব খেতে পারতাম। গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীত সব ঋতুতে একই রকম অনুভব করতাম। পোষাক পরা, আবাসস্থল তৈরি করা, উঁচু-নিচু কোনো ভেদাভেদ থাকত না। সুখানুভূতি চিরস্থায়ী হতো, কোনো হতাশা থাকত না। ভালো কাজের পূর্ণাঙ্গ প্রতিদান পেতাম। মন্দ কাজের শাস্তি পেতাম, জুলুমবাজদের উপযুক্ত শাস্তি দেখতে পেতাম। যে ব্যক্তি দশজনকে হত্যা করেছে তার বিপরীতে তাকে দশবার হত্যা করার স্বাদ নিতে পারতাম। যে মনে আঘাত করেছে তাকে সে আঘাতের সমপরিমাণ আঘাত দিতে পারতাম।
আমাদের আদি নিবাস এবং উপযুক্ত বিচারের মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যম হচ্ছে মৃত্যু। এ জন্য মৃত্যুকে আমাদের ভয় পাওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। আমরা যদি ভালো কাজ করতে থাকি তাহলে ফলাফল জানার তীব্র আশা আমাদের মনে থাকবে। একজন ভালো ছাত্র পরীক্ষার ফল জানতে ব্যাকুল থাকে। বিচারে অংশগ্রহণ ছাড়া সে কিভাবে ফলাফল দেখতে পাবে, ফল অনুযায়ী প্রতিদান পাবে? পুরস্কার পেতে চাই কিন্তু পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে যেতে চাই না তা কি হয়? অপরদিকে দুনিয়ায় এসে কেউ যদি মনের অগোচরে, খেয়ালের ভুলে অথবা স্বেচ্ছায় অন্ধকারের পথ বেছে নেয় তাহলে তাদের বিচারে মাঠে যেতে ভয় করবে। বিচারের ক্ষণ যত কাছে আসবে দুশ্চিন্তা তত বাড়বে, বিচলিত হবে।
দুনিয়ার সুখ শান্তিকে যারা পরম সুখ ধরে চলে, দুনিয়া অর্জনের জন্য ছুটে বেড়ায় তাদের জন্য মৃত্যু একটা দুঃস্বপ্ন। আখেরাতকে বাদ দিয়ে সসীম সময়ের জীবনে অসীম আশার পিছনে ছুটলেও দুনিয়াতে সে শুধু ততটুকুই পাবে যতটুকু আল্লাহ তাকে দেওয়ার ইচ্ছা করবেন এবং আখেরাতে তার কোনো অংশ থাকবে না [৯]। এমন ব্যক্তিকে আল্লাহ আশার পিছনে লেলিয়ে দেন। তখন একটা আশার পর আরেকটা আশার পিছনে ছুটতে ছুটতে মৃত্যুর দ্বারে পৌছে যায়। আবার মৃত্যু ভয় কখনও শয়তানের প্ররোচনার মাধ্যমে হয়ে থাকে। শয়তান মৃত্যু চিন্তাকে খারাপভাবে উপস্থাপন করে, ভয় দেখায়। দুশ্চিন্তায় ব্যক্তির মন মগজকে ধ্বংস করে, ডিপ্রেশনে ফেলে জীবনকে ছোট করে ফেলে। টাকা-পয়সা, সহায়-সম্পত্তি, প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকা সত্ত্বেও ব্যক্তিকে একাকী করে ফেলে।
মৃত্যুকে ভয় না পেয়ে মৃত্যুকে স্মরণ করা একটি ইবাদত [১০]। মৃত্যুকে স্মরণ রেখে ভালো কাজে মনোযোগী হওয়া একজন মুমিনের বৈশিষ্ট, গুণ। এই দুনিয়ায় প্রতিটি মুহুর্তে বেঁচে থাকা, নিশ্বাস নেয়া মুমিনের জন্য সম্ভাবনার, আনন্দের। প্রতি মুহুর্তে আমলনামা ভারী করা যায়। উচ্চ মর্যাদায় আসীন হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করা যায়। এ জন্য সালফে সালেহীনরা বেঁচে থাকার আশা করতেন, আল্লাহর রাহে শত শত জীবন পাওয়ার আকাঙ্খা থকত তাঁদের মনে। মৃত্যুকে স্মরণ আমাদেরকে সর্বদা গতিশীল করে রাখে, কাজের উপযোগিতা বাড়ায়। মৃত্যুকে ভুলে গেলে ভালো কাজের স্পৃহা মনের ভিতর দাফন হতে থাকে, কর্মদক্ষতা হারিয়ে যায়। এজন্য ভালো কাজের উদ্দেশ্যে দুনিয়ার বেশিদিন বেঁচে থাকার আকাঙ্খা করা বৈধ [১১]।
প্রতিদিন, প্রতি-ক্ষণে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। দুনিয়ার দেন-দরবার নগদ করে রাখতে হয়। আল্লাহর হক, বান্দার হক পরিপূর্ণভাবে পরিশোধ করে চলতে হয়। এভাবে চললে কখনও চিন্তিত হতে হয় না, মন ভালো থাকে, জীবনী শক্তি বৃদ্ধি পায়। এই দুনিয়া আমাদের জন্য সব নয়; এটা মাথায় রেখে চলতে হয়, মৃত্যুবরণ করেও শত শত বছর মানুষের দুআয় বেঁচে থাকার সংগ্রাম করতে হয়। পরবর্তী প্রজন্মকে সেই ধারায় চলতে শিখাতে হয় [১২]। রাসূল স. বলেন, “দুনিয়াকে যারা প্রাধান্য দেয়, আল্লাহ তার সকল কাজকর্ম অগোছালো করে দিবেন, তার দুচোখে অভাব দিয়ে দিবেন এবং পার্থিব জীবনে তার জন্য যতটুকু বরাদ্দ আছে তার চেয়ে বেশী কিছু লাভ করতে পারবে না। আর যে ব্যক্তি আখেরাতকে সাথে নিয়ে চলবে বা আখেরাতকে প্রাধান্য দিবে, আল্লাহ তার সবকিছু গুছিয়ে দিবেন, তার অন্তরকে অভাবমুক্ত করে দিবেন এবং দুনিয়ার সকল কিছুকে তার অনুকূল বানিয়ে দিবেন [১৩]।”
আল্লাহর পথে চলা বা মুসলিম হয়ে জীবনযাপন করা স্বাভাবিক জীবন বহির্ভূত কোনো পন্থা নয় [১৪]। মুসলমানিত্ব সন্ন্যাসী, দরিদ্রতা, উগ্রতা, নির্লজ্জতা বা দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ কোনো জীবনব্যবস্থা নয়। মুসলমানিত্ব এক রবের দাস বানিয়ে সকল দাসত্বের (অর্থের দাসত্ব, প্রবৃত্তির দাসত্ব, ক্ষমতার দাসত্ব, শয়তানের দাসত্ব, ভয়ের দাসত্ব, অন্য জীব জন্তুর দাসত্ব ইত্যাদি) শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দেয়। পাঁচটি মৌলিক বিষয় (ঈমান, নামায, রোযা, যাকাত ও হজ্জ্ব) ঠিক রেখে দুনিয়ার কারবারীগুলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দেখানো পথে পরিচালনা করাই ইসলামী জীবনব্যবস্থা, মুসলমানিত্ব [১৫]। ইসলাম আমাদেরকে শুধু দুনিয়া বা আখেরাতের প্রাচুর্যতা অর্জনের জন্য উৎসাহিত করে না বরং দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ের কল্যাণ ও প্রাচুর্যতা অর্জনে উৎসাহিত করে [১৬]।
কল্যাণ ও সফলতার পথে চলতে আমাদের কি কৃপণতা করা উচিত? অমনোযোগী হওয়া উচিত? মৃত্যুর লক্ষণ প্রকাশ পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত? রাসূল স. বলেছেন, “বুদ্ধিমান ঐ ব্যক্তি যে ব্যক্তি নিজের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রন করে এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনের জন্য আমল করে। আর নির্বোধ ও অকর্মন্য সেই ব্যক্তি যে প্রবৃত্তির আকাঙ্খা অনুযায়ী চলে এবং আল্লাহর নিকট ভিত্তিহীন আশা করে” [১৭]। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, “…প্রত্যেকেই চিন্তা করে দেখুক, আগামীকালের জন্য সে কী (পুণ্য কাজ) অগ্রিম পাঠিয়েছে…” [১৮]।
তথ্যসূত্র:
- [১] সূরা নিসা, ৪:৭৭; সূরা তাওবা, ৯:৩৮।
- [২] সূরা হুদ, ১১:৭; সূরা কাহাফ, ১৮:৭; সূরা মুলক, ৬৭:২।
- [৩] সূরা আদ দাহর, ৭৬:৩।
- [৪] সূরা বালাদ, ৯০:১০।
- [৫] সূরা ত্বহা, ২০:১৩১; সূরা নাহল, ১৬:৮০, সূরা আল হিজর, ১৫:২০; সূরা আন নজম, ৫৩:৩৯।
- [৬] সূরা আশ-শূরা, ৪২:২২; সূরা আল ইমরান, ৩:১২, সূরা বাকারা, ২:২৫।
- [৭] সূরা আরাফ, ৭:৮।
- [৮] সূরা বাকারা, ২:৩৫-৩৬।
- [৯] সূরা বনী ইসরাইল, ১৭:১৮; সূরা আশ-শুরা, ৪২:২০; সূরা হুদ, ১৫:১৬।
- [১০] তিরমিজি, ২৩০৬, ইবনু মাজাহ, ৪২৬০, তিরমিজী, ২৪৫৯।
- [১১] মুসলিম, ৬৯৯৫।
- [১২] সূরা ফস্সিলাত, ৪১:২৯; বুখারী, ৩৬৫২।
- [১৩] সুনানে তিরমিযী, সুনানে আবু দাউদ, সুনানে আদ দারেমী।
- [১৪] সূরা তাওবা, ১২:৪০; সূরা আর রূম, ৩০:৩০।
- [১৫] সূরা জুমআ, ৬২:১০।
- [১৬] সূরা বাকারা, ২:২০০-২০১।
- [১৭] সুনানে তিরমিযী, সুনানে ইবনে মাযাহ, সূত্র: মিশকাতুল মাসাবীহ।
- [১৮] সূরা আল হাশর, ৫৯ : ১৮।