You are currently viewing মৃত্যু: রবের এক আদেশ!

মৃত্যু: রবের এক আদেশ!

মৃত্যু ও মৃত্যু ভয় (১)

 

মৃত্যু এক চিরচারিত অমোঘ সত্য, যা থেকে কোনো প্রাণীই রেহাই পায় না [১]। মৃত্যু পূর্ব লক্ষণ প্রকাশের পর অথবা কোনো লক্ষণ ছাড়াই আমাদেরকে গ্রাস করে নেয়। যে লক্ষণ প্রকাশে অথবা ’কারণে’ আমরা মারা যাই সেটা একটা সান্তনা মাত্র, চলার জন্য একটা পাথেয়। যদি ‘লক্ষণ’ না থেকে সর্বদা হুটহাট করে মানুষ মারা যেত তাহলে কেমন হত? কল্পনা করুন তো! কেউ কোনো কাজ করার ভরসা পেত না। হাত গুটিয়ে বসে থাকত। মানুষে মানুষে ভালোবাসা থাকত না। পরিবার থাকত না, দায়িত্ব থাকত না। এজন্যই আল্লাহ মৃত্যুর কিছু নিদর্শন দিয়েছেন [২] যেটা দেখলে আমরা বুঝতে পারি যে মৃত্যুর সময় এসেছে। কিন্তু তাই বলে লক্ষণ প্রকাশ বা কারণগুলোই সব তা নয়। ‘কারণ’ থেকে পালায়ন কিংবা সর্বোচ্চ পন্থা অবলম্বন করেও মৃত্যুকে রুখে দেওয়া যায় না [৩]। বিনা লক্ষণেও আমরা যে কোনো মুহুর্তে মারা যাই। এর পিছনে হিকমত হলো মানুষের জীবনের একটা লক্ষ্য আছে: আল্লাহর আদেশ পালন করা। যেটা মানুষ ও জ্বীন ব্যতীত অন্য কোনো প্রাণীর জন্য নেই। জন্মের পরে বুদ্ধির পরিপক্কতা আসলেই আদেশ পালন করতে হয়। আমরা যেন দায়িত্ব ভুলে না যাই, জীবন-যৌবনের ষোলকলায় যেন অবাঞ্চিত আমোদ-ফুর্তিতে মেতে না উঠি, খাওয়া-দাওয়া-ঘোরাফেরা আর ঘুমকেই যেন জীবন মনে না করি, শুধু কারণ/ লক্ষণ ফুটে আসার ফুরসতে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত যথেচ্ছ জীবন পরিচালনা না করে মহান লক্ষ্যে সর্বদা নিজেকে ধাবিত করতে পারি এ জন্য এর সময় ক্ষণ বা লক্ষণ তাঁরই জ্ঞানের অধীন করে রেখেছেন [৪]। তিঁনি ব্যতীত কারো কোনো সাধ্য নেই এটা জানার বা বোঝার [৫]।
.
এজন্য কখনও কোনো পূর্ব লক্ষণ ছাড়াই আমরা মৃত্যুর কোলে ঢলে পরি। যেমন ধরুন কেউ তার সন্তান দুনিয়ায় আগমনের উপলক্ষ্যে প্রসব বেদনারত স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতালে অপেক্ষার প্রহর গুনছে। মনে মনে খুব ভয় কাজ করছে, না জানি সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে তার স্ত্রীর কিছু হয়ে যায়? সন্তানকে কি জীবিত দেখতে পাবে না মৃত? টেনশনের এক পর্যায়ে সুস্থ সন্তানের ডাক শুনতে পেল। কাছে গিয়ে প্রিয়তমার মৃদু তৃপ্তি হাসিও খুঁজে পেল। খুশিতে সে আত্মহারা। এই খুশি চারদিকে ছড়িয়ে দিতে দ্রুত ছুটে গেল মিষ্টির দোকানে; মিষ্টি কিনতে। কিন্তু স্ত্রী-সন্তানের মৃত্যু চিন্তায় বিভোর আত্মভোলা লোকটার সহসাই গাড়ীর চাপায় মৃত্যু হওয়ার ঘটনা আমরা অসংখ্য শুনেছি, দেখেছি। প্রিয়জনদের জানাযায় শরীক হতে গিয়ে পরিবারের সকলেই পথিমধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে এমন ঘটনাও আমরা শুনেছি অহরহ।
.
আবার মহাবীর খালিদ বিন ওয়ালিদ রা. এর কথাই ধরুন। যিনি জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন তারবারীর নিচে। শাহাদতের আকাঙ্খায় যুদ্ধের মাঠে লড়েছেন নির্বিঘ্নে। প্রতিটি যুদ্ধেই তাঁর বাহিনীর তিন-চারগুন বেশী সৈন্যবাহিনীর সাথে মোকাবেলা করেছেন। যুদ্ধের জরুরী মুহুর্তে শত্রু বলয়ের প্রবল জনস্রোতে ঢুকেছেন অসংখ্যবার। কিন্তু তিঁনি যুদ্ধের ময়দানে মৃত্যুবরণ করেন নাই। তিঁনি নিজ বিছানায় বিশ্রামরত অবস্থায় আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গেছেন। আরেক সেনাপতি আবু উবাইদা রা.? তিঁনিও তো তরবারীর আঘাতে মৃত্যুবরণ করেন নাই। তিঁনি আল্লাহর সান্নিধ্যে গিয়েছিলেন এক মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে। অন্যদিকে ওমর রা.? তিঁনি রাষ্ট্রনায়কের দায়িত্বপালন করছিলেন মদিনায় বসে। কোনো এক শান্ত-শিষ্ট পরিবেশে নামাযে ইমামতির দায়িত্ব পালনকালে দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে শাহাদতবরণ করেছিলেন। সুতরাং মৃত্যুর কোনো নির্দিষ্ট লক্ষণ নেই, কারণ নেই। এর সময়ও কেউ বলতে পারে না। আল্লাহই নির্ধারণ করেন কে কোথায় কিভাবে মারা যাবে।
.
হযরত সুলাইমান আ. এর সময়ের এক ঘটনা। তিনি সাথীদেরকে নিয়ে এক সভায় আলোচনা করছিলেন। এমন সময় এক অগন্তুক এসে তাঁকে সালাম দিলেন। এরপর এক ব্যক্তির দিকে কয়েকবার তাকিয়ে সেখান থেকে চলে গেলেন। লোকটি চলে যাওয়ার পর সুলাইমান আ. উপস্থিত সকলকে বললেন, তোমরা কি জানো লোকটা কে? সকলে বলল, না। তিনি বললেন ইঁনি হলেন মৃত্যু দূত। আল্লাহর আদেশে সকলের জীবন কেড়ে নিয়ে থাকেন। একথা শুনে যে লোকটার দিকে বার বার তাকিয়ে ছিল সে ভাবনায় পড়ে গেল। মৃত্যু ফেরেশতা হয়ত তার জীবন নেওয়ার জন্য এখানে এসেছিলেন। ভয়ে বিহ্বল হয়ে তিনি সুলাইমান আ. এর নিকট মিনতি করে বললেন তিনি যেন তাকে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দেন। তার চাহিদামত সুলাইমান আ. তার অধীনে থাকা বাতাসকে নির্দেশ দিলেন যেন তাকে এক দূর অজানায় রেখে আসে। নির্দেশমত বাতাস তাকে সেখানে দিয়ে আসল। এর কিছুক্ষণ পর আবার সেই মৃত্যু দূত এসে সালাম দিলেন। সুলাইমান আ. তাকে আবার আসার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। সে বলল, হে আল্লাহর নবী! আজকে আমি একজন লোকের জীবন নেওয়ার জন্য আদিষ্ট হয়েছি। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের কিছুক্ষণ আগে এসে তাকে আপনার মজলিসে দেখতে পাই। অথচ তার মৃত্যুর স্থান এখান অনেক দূরে লেখা ছিল। অল্প সময়ে সে সেখানে কিভাবে যাবে সেটা নিয়ে আমি চিন্তিত ছিলাম। যাইহোক আমি চিন্তিত মনে যথাসময়ে সেই যায়গায় উপস্থিত হই। গিয়ে দেখি লোকটি যথাসময়ে সেখানে উপস্থিত। আমি তার জীবন নিয়েই আপনাকে আবার সালাম দিতে আসলাম!
.
মৃত্যু এক পরাধীন সত্ত্বা [৬] যার নিজস্ব কোনো পছন্দ-অপছন্দ নেই। নেই কোনো চাওয়া পাওয়া। সে শুধুই পরাক্রমশালী রবের নির্দেশে চলে [৭]। দুনিয়ায় বসবাসরত প্রাণীর দেহ থেকে আল্লাহর আদেশকে (জীবন/ রূহকে) দুনিয়ার জিন্দেগী থেকে এক অনন্ত জগতে স্থানান্তর করে [৮]। এই পরাধীন সত্ত্বাকে নিয়ে চিন্তা করলে বা ভাবলে আমাদের জন্য কোনো ফায়দা নেই। এর কোনো অনুভূতি নেই। আমাদের চিন্তায় এর উপরে কোনো প্রভাব নেই, দয়া-মায়া নেই। বরং মৃত্যুসহ আমাদের যিনি মালিক [৯] তাঁকে নিয়ে চিন্তা করা যায়। তাঁর সাথে আমাদের সম্পর্ক কেমন সেটা নিয়ে দিন পার করা যায়। আমি তাঁর কথা প্রতি মুহুর্তে শুনছি কিনা সেটা নিয়ে ভাবা যায়, কাজ করা যায়। তাঁকে বলে আমাদের পছন্দমত মৃত্যু নিয়ে আসা যায় [১০]।
.
আল্লাহর সাথে যাদের ভালো সম্পর্ক ছিল তারা তাদের পছন্দের মৃত্যুর সময়-পদ্ধতি চেয়ে নিয়েছেন। আল্লাহকে বন্ধু বানিয়েছেন এমন এক ব্যক্তির স্ত্রী তার কাছে এসে বললেন: ওগো শুনছেন! আমি আপনার শাসনামলে (আপনি জীবিতাবস্থায়) মরতে চাই! আপনার মৃত্যুর পর কে কিভাবে আমাকে পালন করবে তার কোনো ঠিক নেই, তাই আপনি থাকতেই আমি মৃত্যু চাই। ব্যাস! যেরকম চাইলেন আল্লাহ তেমনই দিলেন; তার স্বামীর জীবদ্দশাতেই তিনি মারা গেলেন। আল্লাহর আরেক অলী আল্লাহর কাছে বললেন, হে আল্লাহ! আমাকে আপনি অপরের কাঁধে ভর দিয়ে চলতে হয় এমন কোনো রোগে ভুগিয়ে মৃত্যু দিবেন না। নিজের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রন থাকতে আমাকে মৃত্যু দিয়েন। ব্যাস! যেমন চাওয়া তেমনই পাওয়া।
.
সুলাইমান আ. এর মৃত্যুর কথা কি আমরা জানি? তিনি যখন জ্বীনদের দিয়ে বাইতুল মুকাদ্দাস তৈরি করছিলেন এমন সময় মৃত্যু দূত এসে হাজির। মৃত্যু দূত এসে তাঁকে সালাম দিয়ে তাঁর মৃত্যুর সময় এসেছে বলে জানালেন। সুলাইমান আ. দেখলেন মসজিদ বানানোর কাজ এখনও অনেক বাকী। এমতাবস্থায় তার মৃত্যুতে জ্বীনেরা বাকী কাজ আর সম্পন্ন করবে না। তিনি আল্লাহকে বললেন, আল্লাহ আমাকে এমন এক ব্যবস্থা করে দিন যেন জ্বীনেরা বাকী কাজ সম্পন্ন করে। তার চাওয়া মোতাবেক জীবন কেড়ে নেওয়া হলো। আল্লাহ তাঁর মৃত শরীরকে হাতের লাঠির উপর ততদিন পর্যন্ত দাঁড় করিয়ে রাখলেন যতদিন না জ্বীনেরা সকল কাজ শেষ করে। কাজ করা যেদিন শেষ হলো সেদিন উঁইপোকাও লাঠি ভেঙ্গে পড়ার জন্য সর্বশেষ কামড় দিলো এবং তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন [১১]। স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক থাকলে তার ব্যাপ্তি এতদূর পর্যন্তও হয়! তিনি সকল চাওয়া পূরণ করেন। ইচ্ছা হলে মৃত্যুর ক্ষণ সরিয়ে দেন! মৃত্যুর পন্থাও বদলে দেন!

তথ্যসূত্র:

Leave a Reply